সিদলার সাহেবের চরে দুর্ভাগাদের বাস

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ২০-৩০ বছর ধরে ভাঙনের শিকার গ্রামটির এমন কোনো পরিবার নেই যাদের বসতঘর দুই-তিনবার সরিয়ে নিতে হয়নি। অনেককে এখন সরকারি রাস্তা, এমনকি গ্রামের কবরস্থানে ঘর তুলে বসবাস করতে হচ্ছে। থাকার মতো জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কত মন্ত্রী-এমপি গ্রাম রক্ষায় কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামের শিশুদের পড়াশোনার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়ে গেছে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের সাহেবের চর গ্রামের অসহায় মানুষ এ অবস্থায় কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একসময়ের বিশাল গ্রাম এখন এক চিলতে জনপদে পরিণত হয়েছে। যেখানে গাদাগাদি করে থাকছে তারা।

গ্রামের বৃদ্ধ মো. শহীদ মিয়া বলেন, ‘নদী সব নিছে। যাওনের জাগা নাই। গোরস্তানে থাহি। এহন ফুলাপানও বেকার অইল। ’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘এইতা লেইক্যা কী অইব? ক্যামেরার তামশা আর কত দেখবাম? কামের কাম কেউ করে না। গরিবরারে লইয়া সবাই খেলে। ’

সাহেবের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমন রঞ্জন সরকার বলেন, ‘ঘটনাটা রাতে হওয়ায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ক্লাস চলাকালীন হলে এখানে কী ঘটত কল্পনাও করতে পারছি না। ’ তিনি জানান, বেঞ্চ-টেবিল, আসবাবপত্রসহ সব কিছু বিদ্যালয়ের ভেতরেই ছিল। কিছুই রক্ষা করা যায়নি।

হোসেনপুর উপজেলা শিক্ষা অফিস জানায়, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি আরো দুবার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার হয়েছে। পরে ১৯৯৯ সালে অন্য জায়গায় নতুন করে বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়।

বিদ্যালয়ের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চরাঞ্চলের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখানে অনেক শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনের কারণে লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। যে কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বতর্মানে ২২৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এখন ওদের পড়াশোনা কিভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছি। বর্তমানে বিদ্যালয়ের সামনে খোলা আকাশের নিচেই চলছে পড়াশোনা। ’

স্কুল পানিতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইমরান, রঞ্জন ও সাদিয়ার মন খারাপ। তাদের মধ্যে সাদিয়া বলে, ‘আমরার গেরামের সামনে একটা ওয়াল কইরা দিলেই তো সব ঠিক থাহে। গেরামও ভাঙে না, ইস্কুলও ঠিক থাহে। ’

ভাঙনের শিকার বিদ্যালয় এলাকা পরিদর্শন করে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্রোতের তীব্রতায় গ্রামটির বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। নদীর তীর রক্ষা প্রকল্পে গ্রামটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটির অনুমোদন পাওয়া গেলে গ্রামের সব কিছুই রক্ষা পাবে। ’

স্থানীয় ফরিদ আহমদ বলেন, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার হয়ে গ্রামের অনেক মানুষ এলাকাছাড়া। সরকার একটি আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করলে তাদের উদ্বাস্তু জীবনের অবসান হতো।

গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদ খাঁ জানান, তিনি একসময় মোটামুটি সচ্ছল কৃষক ছিলেন। এখন তার সব জমি পানির নিচে। বসতঘরটিও তিনবার পিছিয়েছেন। এখন পেছনে যাওয়ার আর জায়গা নেই।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়নি। আপাতত বিকল্প ব্যবস্থায় চালানো হচ্ছে।

হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিদ্যালয়টি অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে পরিচালনা কমিটির সভাপতি প্রয়োজনীয় জায়গা দিতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। ওই জায়াগায় মাটি ভরাট করে স্কুল করার উপযোগী করতে সময়ের প্রয়োজন। তাই জরুরি ভিত্তিতে একটি ঘর বানানোর জন্য ২০ বান্ডিল টিন ও তিন লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যেন শিশুদের পাঠদান বন্ধ না থাকে। ’

কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার আক্তার জামিল জানান, সাহেবের চর গ্রামটি রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভাঙনের শিকার লোকজনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তা ছাড়া তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। শিশুদের পড়াশোনা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য বিকল্প স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর